গদ্য গল্প 

ইনস্কেপ্যেবল মাইন্ড ।। তাইবা তুলবি

‘আমি খুন করেছিলাম’,  রবির গলা দিয়ে উষ্ণ তরল নেমে গেলো।
স্বর্গে কখনো কড়া রোদ পড়ে না। মিষ্টি রোদ, মৃদু বাতাস। এখানে নরকের মতোন এতো ঝামেলা পোহাবার কোনো মানে নেই, এতো ভাবনার কোনো কারণ নেই। মাত্র সেকেন্ডে এসব ভেবে তার বন্ধু অনন্ত আলসে মুখে চোখ ফেরায়। সে এক কথায় বলতে স্বাচ্ছন্দ্যে বোধ করলো। ‘তুই এখন স্বর্গে, অতোকিছু ভাবিস না’,হাতে থাকা পাকা হলুদ ফলটা ফস ফস করে চিবুতে থাকলো সে।
শুকনো পাতার মতোন মুখ হয়ে আছে রবির। রবি বলতে লাগলো, ‘দুটো ডানা ছিলো মেয়েটির। সাধারণত লোকে একে পরী বলে থাকে। মানুষ কখনো পরী দ্যাখেনি, যেমনটি আমিও। এতো পুরাতন একটা শহরে পরী দেখাটাই আশ্চর্যের!
চারিদিকে খুব পুরাতন একটা পরিবেশ মনে হলো। যেন বহুদিন বৃষ্টি হয়নি ওই শহরে। ধূলো-ময়লায় ভরা পুরো শহরটাকে দেখে মনে হয়, যেন শহরটির চোখের পাতা যুগ যুগ ধরে বন্ধ হয়ে আছে।
আমি দেখতে পেলাম দু’জন মোটাসোটা মহিলা ধবধবে সাদা ডানাওয়ালা মেয়েটিকে চেপে ধরে বাথরুমে ঢুকালো। তারপর তাকে জোরপূর্বক ঠেলা দিয়ে দ্রুত দরজাটা লক করে দিলো; মৃদু গানের শব্দও শুনছিলাম ওখানে।’
‘কোন গানটা বাজছিলো?’ অনন্ত এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে বলল।
ইতিমধ্যে সে ফলটা খাওয়া শেষ করে ফেলেছে।
এতো ভিন্ন সব গাছে অচেনা মিষ্টি ফলগুলো তার নজর কেড়ে নিচ্ছিলো প্রথমদিন থেকেই। সে ভাবছে, নতুন আর কি খাওয়া যায়।
রবি চোখ বুজে স্মৃতির ঘরগুলো হেঁটে একবার মনে করার চেষ্টা করে, ‘কি একটা ভাষার গান আমি জানি না। কিন্তু সুরটা চেনা বলা যায়।’
চোখ খুলে, বিশাল ফুলগাছের ডালে বসে থাকা সাদা পাখিটার দিকে অন্যমনস্ক দৃষ্টি দিয়ে আবারো বলা শুরু করে সে, ‘আমি ডানাওয়ালা মেয়েটিকে মানে পরীটাকে বাঁচাতে গেছিলাম। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে না ঢুকতে কোথা থেকে দ্রুত দুটো সবল দেহ এসে আমায় চেপে ধরে রইলো। এতোটাই শক্তি তাদের প্রথমে বোধ হলো তারা ছেলে।
তাদের ভাজবহুল হাত যথেষ্ট চাপ প্রয়োগ করছিলো আমায়। শরীর অবশ হয়ে যাওয়ার মতোন অনুভূত হচ্ছিলো। কিন্তু তারা ছেলে নয়, মহিলাই ছিলো।’ অনন্ত মৃদু হেসে বলল, ‘আহা! তুই এতো ঘাবড়ে আছিস কেন তুই তো এখন স্বর্গে!’
রবি হাতের ঘাম পাজামায় মুছে, ‘আমার তো স্বর্গে থাকার কথা নয়। আমি পাপী। খুনি! খুন করেছি।’
অনন্ত খেতে খেতে, ‘আচ্ছা, তারপর শুনি। বলে যা।’
‘অবশ হয়ে ঢলে পড়ার মুহুর্তেই বিদ্যুতের মতোন কেমন একটা সাহস আর জোর চলে আসে আমার ভেতরে। আমি তখনই আমার ডান হাতের বাহু দিয়ে পাশে চেপে ধরা মহিলাটিকে একটা ঘুষি দিই। মহিলাটি জন্তুর মতো চিৎকার করতে করতে মেঝেতে বসে পড়ে।
একজন আঘাত পাওয়ায় এবার অন্যজনের চাপটাকে এতো ভারি মনে হলো না। তাকেও হেঁচকা টানে মাটিতে ফেলে দিলাম। এদের সাথে কি খেলা খেলছি আমি! আমার নিজেকেও একটা জন্তু মনে হচ্ছিলো। জঘন্য! 
মহিলা দুটো তেমন অবস্থাতেই আমায় কুৎসিৎ গালিগালাজ ছুঁড়তে লাগলো। আমার খুবই খারাপ লাগছিলো। তবু এতোকিছু ভাবার সময় কই! ওসব না শুনে বাথরুমটার দরজা ভাঙ্গার উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেলাম। কয়েকবার লাথি দিতেই ঠুংকো লকটা সহজেই ভেঙ্গে গেলো। ভেতরে নজর দিতেই দেখলাম মেয়েটি মানে বাথরুমের মেঝেতে পড়ে আছে। ডানা আধ-খোলা তার। সম্ভবত উড়ার জন্য ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলো। বাথরুমের অপরিষ্কার বালি-কাদা-জল সাদা দুটো ডানায় মেখে গেছিলো একেবারে।’
হঠাৎ একটা বিশাল শব্দে, কথা থামিয়ে চুপ হয়ে গেলো রবি।
অনন্তও শোনা, খাওয়া থামিয়ে দিয়ে পশ্চিম দিকে বয়ে যাওয়া কাঁচের মতো স্বচ্ছ নদীর দিকে তাকালো।
ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা এসে ডুব দিয়ে আরও উঁচু আকাশের দিকে উড়াল দিচ্ছে। শতশত পাখিরা একসাথে পানিতে ডুব দেওয়ায় একটা বড় শব্দ ছড়িয়ে পড়ছে স্বর্গের অসীমতার দিকে।
দৃশ্যটি ক্ষাণিক দেখে এড়িয়ে আবার স্বাভাবিক হলো তারা। এমন দৃশ্য এখানে প্রতিদিনই দেখা যায়। তবু প্রতিবারই দেখতে ভালো লাগে।
অনন্ত স্বর্গীয় ফলটা শেষ করে নদীটা লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিলো। তারপর আরেকটা নতুন ফল খোঁজার উদ্দেশ্যে এদিক-ওদিক চোখ ফেরাতে লাগলো। অনন্ত কখন থেকে এখানে এসেছে তার মনে নেই। কারন সময় নিয়ে এখানে কারও মাথা ব্যথা থাকেনা। কিন্তু শুরু থেকেই এখানকার ফল খেতে তার বেশ লাগে।
রবি আবারও মেয়েটির কথা শুরু করলো, ‘এমনই এক স্বর্গ থেকে সে এসেছিলো হয়তো। আমি জানি না সে কোথাকার, সে কে!
আমি তখন শুধু ভাবছিলাম তাকে বেঁধে রাখা মোটেও উচিৎ নয়। তার তো ডানা আছে। সে উড়তে জানে। উড়তে দেবে না কেন! তাই আমি লড়াই করেছিলাম ওই মহিলা দুটোর সাথে।
‘হুঁ’, মাথা নাড়ে অনন্ত। ‘তারপর?’
‘আচ্ছা, কিন্তু ওদেরও তো দোষ নেই। নতুন কিছু দেখলে এমন করতেই পারে। বোধ জন্ম নেয়নি হয়তো তাদের। তাই তারা এমন কাজ করতে পারছে। তবু আমার তো বোধ আছে। সেক্ষেত্রে আমি তাদের মতোই দোষী কিংবা তাদের চাইতেও বেশি।
তারা বেঁধে রেখেছিলো। কাউকে খুন তো করেনি। একটা জীবন তারা শেষ করতে পারেনি অন্তত। ওই নির্দয়তা তাদের ছিলো না।’
অনন্ত বলল, কিন্তু, মানুষের ভিতরে ইশ্বর নিজেই তো বসে আছেন। তারা কেও মন্দ নয়। সবাই ভালো। তুইও ভালো, মহিলাগুলোও ভালো। এতো ভাবিস কেন!’ বলতে বলতে একটু হেঁটে সামনের দিকে এগোলো সে। রবিও তার সাথে সাথে চলল। 
অনন্তর কথায় সবসময় আস্থা-ভালোবাসা চোখে পড়ে শুরু থেকেই। কথাটা যে বিষয়ে হোক, তার মতামত থাকে মাঝামাঝি। যেন সে নিজেই মাত্র ঘটনাটা বুঝে নতুন কিছু উপলব্ধি করেছে।
অনন্ত আর রবির বন্ধুত্বের কত সময় হয়েছে তা অনুমান করা যায় না। তবু অনন্ত আপন করে নিতে পারে যে কাওকে সহজেই।
‘তারপর বল খুনটা কি করে হলো?’
জিজ্ঞেসা করতে করতে অনন্ত তার খোঁজার কাজ চালিয়ে গেলো।
‘ওই ডানাওয়ালা মেয়েটিকে আমার কাঁধে চাপিয়ে নিই। কিন্তু মহিলা দুটো বের হতে দিচ্ছিলো না। একজনকে কোলে নিয়ে ওই দু’জনের সাথে একা লড়াইয়ে পেরে উঠতাম না। তাই ডানা সমেত মেয়েটিকে যত্ন করে একপাশে রাখি আমি। তারা ততোটুকুতেই তাকে আঘাত করতে উন্মাদ হয়ে গেলো। আমি খুব চেষ্টা করি কিন্তু—
কোনো উপায় না পেয়ে, আমি টেবিল থেকে দুটো কাটা চামচ নিয়ে একজনের গলায় বসিয়ে দিই।’
অনন্ত এবার থমকে দাঁড়ালো, সে খুব অবাক হয়ে রবির দিকে চেয়ে রইলো।
‘আমি খুব উগ্র হয়ে গেছিলাম, হঠাৎ কোথা থেকে সাহস চলে এসেছিলো আমি জানি না।মুহুর্তে যেন একটা হিংস্রতা চেপে ধরেছিলো আমাকে। বুঝতে পারছিলাম না সেই আমিই কিনা যে এমনটা করেছে।
‘দু’ফোটা তপ্ত ঘাম জমে উঠলো রবির কপালের উঁচুভাগে।
‘মহিলাটির অবাক ভঙ্গিতে থাকা চোখদুটো বড় বড় করে পাকিয়ে ছিলো আমার দিকে। সেও হয়তো আমায় এতোটা জঘন্য ভাবেনি’, বলতে বলতে এখন কাঁদো কাঁদো স্বর বেরিয়ে আসবে রবির।
‘তারপর, তারপর কি হলো?’
‘কিছু বলার সুযোগ না পেয়ে তার বিশাল দেহটি স্বশব্দে মাটিতে পড়ে গেলো। আর অন্যজন তাই দেখে আতঙ্কিত হয়ে পালালো। আর ওই ডানাওয়ালা মেয়েটিও কখন যে উড়ে গেলো! আমি দেখতে পায়নি। আমি খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম। কি করতে পারতাম আমি! ভয় নাকি পশুত্ব জেগে গেছিলো আমার! আমি পশু!’
তাকে সান্ত্বনা দিয়ে অনন্ত আবার তার কথাটা বলল, ‘কিন্তু এখন তো তুই স্বর্গে! শুধু শুধু এমন করছিস!’ এটাই যথাযথ সান্ত্বনা। স্বর্গের মতো এতো বড় পাওনা  যার কাছে আছে, তার কোনো ভাবনা থাকতে পারে না।
‘অপরাধ বোধের সাথে স্বর্গের কোনো কানেকশন নেই। আমি কি করে এই অপরাধ বোধকে ‘না’ করি, বলল রবি।
ধীরে ধীরে হেঁটে একটি গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ালো দু’জন। গাছটির উপর থেকে নিচে ঝুলে আছে হলুদ-লাল ফল। হাতের কাছেই আছে বেশ ডজনের মতোন। লাল দেখে একটা ছিঁড়ে রবির দিকে বাড়িয়ে দিলো অনন্ত।
রবি না বোধক হালকা মাথা নাড়িয়ে চুপ করে রইলো। তার মন কোনোভাবেই ভালো নেই।
রবির অনুভূত হচ্ছে, তার সে পুরোপুরি মন্দ একজন লোক। আর তাই তার কথায় বিশেষ কোনো আগ্রহ দেখাতে পারছে না তার বন্ধু।
অনন্ত আবারও বলল,’তুই শুধু শুধু এতো ভাবছিস! বলে যা। তারপর কি হলো; ফলগুলো তো খুব দারুন খেতে।’
রবি বিষয়টা ভুলে যাবার চিন্তা করে গাছটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি নাম?’
‘তুই না হয় রেখে দিবি নাম একটা। ফলটা যেহেতু ভালো, নাম একটা দেয়া উচিৎ। এখানে তো ফলের অভাব নেই। সংখ্যায় নাম রাখতে গেলে ইনফিনিটিতে দাঁড়াবে।
তুই বলে যা, আমি শুনছি। তারপর কি হলো?’
‘আমি পালিয়েছিলাম। সেদিন সারাদিন পলাতক ছিলাম। বাসে, ট্রাকে চড়ে অচেনা কোন শহরে যাচ্ছিলাম নিজেও জানি না । বুঝতে পারছিলাম পরিবার, বন্ধু, সবকিছু হারিয়ে ফেলেছি।
এখন তো আমি খুনি হয়ে গেছি। সাজা তো পেতেই হবে। আমরা নিজেদের কর্মফল কখনো এড়াতে পারি না। বাঁচলে একভাবে আর মরলে অন্যভাবে।’
‘হুম, তা মিথ্যা নয়।’ অনন্ত গভীরতা বুঝতে বুঝতে বলল।
‘রাত হতেই একা সমুদ্রের মত উত্তাল ঢেউ খেলছিলো মনে। কতটা নিঃস্ব অপরাধী আর ছোট লাগছিলো। কি করে বোঝাবো! কেও ছিলো না, কেও না। এখনও নেই! একটা মালবাহী ট্রাকের পেছনে উঠেছিলাম। একদল ডাকাতও ছিলো ট্রাকটায়। কাদের ভিড়ে চলে গেছিলাম আমি!’
মাথায় হতাশার হাত ঝুলিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে রবি। কিসব ভাবনা তার মুখে এসে থেকে থেকে আবার মিলিয়ে যায়।
‘সময়টার কথা মনে করিস্ না আর।’
‘কাজটা অন্য কেও তো করেনি। আমার মস্তিষ্ক, আমার কাজ, আমার চিন্তা সবকিছু প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেছিলো সেই মুহুর্তে এবং আমি এখনো প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছি।’
তারপর মুহুর্তেই কি ভেবে একটা কঠিন মুখে পরিণত হলো রবির সাদাসিধে মুখটা। বললো, ‘আমি একটা মানুষের জীবন কেড়ে নেয়ার মতোন অপরাধ করেছি। এরচেয়ে বড় অপরাধ কিছু নেই। কিছুই নেই। এই কঠিন কষ্ট নিয়ে আমি কি করে থাকবো।’
‘যাক বেঁচে থাকবো তো বলতে পারিস্ না, হা,,হা,,।
কারণ আমরা কেও বেঁচে নেই। মরে গেলে কোনো ভাবনা নেই। তাই তো মানুষ মৃত্যু চাই। তুই মৃত্যু পেয়েছিস্। ব্যস্ হয়ে গেলো তো’, অনন্ত বলল।
‘আচ্ছা, তো তারপর কি হলো?’
‘রাস্তায় বসে ছিলাম, গাড়ি থেকে নেমে। তখন চারিদিকে করোনা ভাইরাসের আতঙ্ক।’
ফলটির শেষ অংশ খেতে না পেরে আবারও নদী লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিলো অনন্ত। আধ খাওয়া ফলটি নদী অবদি গেলো না। এতে তার গোলগাল মুখে একটা ব্যর্থতা প্রকাশিত হলো।
‘আচ্ছা,তারপর? তোর জেল হলো?’
‘না। ঘুম ভেঙ্গে গেলো।’
বাক্যটি শোনা মাত্র একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো, অনন্ত।
‘বুঝেছি’, বলতে বলতে মিষ্টি রোদে পাতানো সবুজ চাদরটায় শুয়ে পড়লো এবার।
রবিও পাশে বসলো। রবি বলল, ‘স্বর্গের মিষ্টি রোদে জ্বলন্ত নরকে পুড়ছিলাম আমি এতোক্ষণ। কতটা জঘন্য আমি। অথচ আমি স্বর্গে! আমার কোনো অধিকার নেই এখানে থাকার!
আমার মন তো স্বর্গে বসেও খুন করেছে।’ বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে রবি। দুঃখে ঘৃণায় তার যেন নিজেকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে হয়। কিন্ত মৃত্যু এখানে চাইলেই পাওয়া যায় না।
‘স্বপ্নেই তো! বাস্তব না! অতো ভাবিস না তো। আমি ভাবছিলাম, তোর পার্থিব জীবনের কথা বলছিস।’
‘কিন্তু স্বপ্নের মানুষটা কি আমি নই। আমার মন খুন করতে পারে বলেই আমি স্বপ্নে তা পেরেছি। এটি কি মিথ্যে?’
অনন্ত পাশ থেকেই আবারও একটা ফল ছিঁড়ে বলল, ‘উম,  মিথ্যা নয়। আমরা সবাই বোধহয় একই। সবাই এখানে আসার অধিকার রাখে কিংবা কেউই না।

Related posts